দুই হাজার সতের সালে সালে মিয়ানমার থেকে যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠি ব্যাপকভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ শুরু করে, তার ৫ বছর পূর্ণ হচ্ছে ২৫শে অগাস্ট।
মিয়ানমারের রাখাইনে দেশটির সামরিক বাহিনীর হাতে নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে প্রবেশ নিয়ে প্রথমে কিছুটা অনিশ্চয়তা দেখা দিলেও খুব দ্রুতই রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ।
সেসময় কক্সবাজারের স্থানীয় বাসিন্দারা রোহিঙ্গাদের নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেছিলেন।
কক্সবাজারে বালুখালির আব্দুর রহমানের বাড়ির কাছেই রোহিঙ্গা ক্যাম্প। দুই হাজার সতের সালে যখন রোহিঙ্গারা এসেছিল তখন তিনি ভেবেছিলেন, বিষয়টি হয়তো সাময়িক।
কিন্তু পাঁচ বছর পার হলেও তাদের মিয়ানমারে ফিরে যাবার কোন লক্ষন নেই। ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে আব্দুর রহমানের মুখে কেবলই হতাশা তৈরি হচ্ছে।
“আমরা কখনো কল্পনাও করি নাই যে রোহিঙ্গারা হুট করে এখানে এসে বসে যাবে। আমরা এটা চিন্তাও করি নাই” – বলেন মি. রহমান।
তিনি বলেন, “আজকে পাঁচ বছর হয়ে যাচ্ছে কিন্তু রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন করার সিদ্ধান্ত এখনো আসে নাই। যদি ওরা এভাবে আর পাঁচ বছর থাকে, তাহলে আমাদের ভবিষ্যতে খুব ক্ষতি হবে”
বদলে যাওয়া উখিয়া-টেকনাফ
কক্সবাজারের উখিয়া গত পাঁচ বছরে বদলে যাওয়া এক জনপদ। এক সময় এসব জায়গা যে পাহাড় এবং অরণ্যে ঘেরা ছিল, সেটি বোঝার কোন উপায় নেই। মিয়ানমার থেকে থেকে পালিয়ে আসা লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে এসব জায়গায় আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ।
রোহিঙ্গারা যখন এসেছিল তখন তাদের আশ্রয় দেবার নিজের উঠানের জায়গা ছেড়ে দিয়েছিলেন আনোয়ারা বেগম। এখন তার বাড়ির চারপাশ ঘিরেই রোহিঙ্গা বসতি।
“রোহিঙ্গারা আসার আগে ছয় কানি জমি ছিল। ওখানে গাছের বাগান করেছিলাম। এখন সেসব জমিতে রোহিঙ্গারা ঘর বানিয়েছে,” বলেন আনোয়ারা বেগম।
“ওরা চলে যাবে এই আশায় ঘর তৈরি করতে দিয়েছিলাম। এখন তো ওরা যাচ্ছে না।”
রোহিঙ্গারা আসার পর উখিয়া এবং টেকনাফের শ্রমবাজারও বদলে গেছে। ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে তারা নানা ধরণের কাজ করছেন।
ফলে স্থানীয় বাংলাদেশিদের জন্য এখন কাজ পাওয়া কঠিন হয়ে গেছে।
এর মূল কারণ হচ্ছে, বাঙালিদের চেয়ে রোহিঙ্গাদের শ্রম সস্তা।
স্থানীয় মানুষের অভিযোগ হচ্ছে, রোহিঙ্গারা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা থেকে খাদ্য এবং নানা ধরণের সহায়তা পাচ্ছে। ফলে কম দামে শ্রম দিলেও তাদের অসুবিধা নেই।
কিন্তু স্থানীয় বাসিন্দারা যেহেতু কোন সহায়তা পায় না। সেজন্য শ্রমের টাকাই তাদের মূল উপার্জন।
বকুল রানি বলছিলেন, কাজ পাওয়া এখন বেশ কঠিন হয়ে গেছে।
বাংলাদেশি-রোহিঙ্গা সম্পর্ক কেমন?
গত পাঁচ বছরে রোহিঙ্গা ক্যোম্পের ভেতরে নানা ধরণের অপরাধ তৎপরতা বেড়েই চলেছে।
পুলিশের তথ্য অনুযায়ী গত পাঁচ বছরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পকেন্দ্রীক প্রায় দুই হাজার মামলা হয়েছে।
হত্যাকান্ড, অস্ত্র এবং ইয়াবা চোরাচালানসহ নানাবিধ অপরাধের অভিযোগে এসব মামলা হয়েছে।
অপরাধ যেভাবে বাড়ছে সেটি নিয়ে বাংলাদেশিদের মধ্যে উদ্বেগ ও আতঙ্ক আছে।
এতো কিছুর পরেও স্থানীয় বাংলাদেশিরা রোহিঙ্গাদের কোন দৃষ্টিতে দেখছে?
রোহিঙ্গা নারী মাহদা খাতুন বলেন, “বাঙালিরা আমাদের কখনো নির্যাতন করেনি। তারা ভালো না হলে বার্মা থেকে এসে এখানে কিভাবে থাকতাম?”
“নিরাপত্তা আছে বলেই তো থাকতে পারছি। আমাদেরকে তারা কখনো খারাপ চোখে দেখে না”।
পাঁচ বছর পার হলেও রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে যাবার লক্ষণ না থাকলেও, স্থানীয় মানুষের মধ্যে ক্ষোভ এবং হতাশা থাকলেও সেটি তাদের আচরণে খুব একটা প্রকাশ পায় না।
বরং রোহিঙ্গাদের সাথে তাদের স্বাভাবিক সম্পর্ক আছে।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাইরেই একটি ওষুধ দোকান চালান আব্দুর রহমান। তিনি বলছিলেন, সম্পর্কটা মূলত ব্যবসায়িক।
“আমাদের হান্ড্রেড পার্সেন্ট রোহিঙ্গা কাস্টমার। আগেতো এখানে কোন লোক ছিল না। সে হিসেবে রোহিঙ্গাদের সাথে আমাদের সম্পর্ক খারাপ না,” বলেন মি. রহমান।
উখিয়া এবং টেকনাফে বাংলাদেশিদের চেয়ে রোহিঙ্গারাই এখন সংখ্যাগরিষ্ঠ।
জনসংখ্যার হিসেব-নিকেশে অনেক বাংলাদেশি এ অঞ্চলে নিজেদের ‘সংখ্যালঘু’ মনে করে।
সেজন্য অনেকেই বলছেন, রোহিঙ্গাদের সাথে তাদের ঘনিষ্ঠতা না থাকলেও তাদের এড়িয়ে চলার উপায়ও নেই। সেজন্য স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় রাখাটাই শ্রেয়
স্থানীয় বাসিন্দা সরোয়ার আলম বলেন, “ওরা এখন সংখ্যাগরিষ্ঠ আর আমরা সংখ্যালঘু। এরা যখন আমাদের একটা সমাজের মধ্যে চলে আসছে, ইউনিয়নের মধ্যে চলে আসছে – আমরা তো ওদের এড়িয়ে চলতে পারি না।”
“গভীর সম্পর্ক না থাকলেও ওদের সাথে মিলেমিশেই থাকতে হয়”।
রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে যাবে – সরকারের দিক থেকে এমন আশ্বাস বারবার দেয়া হলেও স্থানীয় বাসিন্দারা সেটি এখন আর সহজে বিশ্বাস করতে চান না।
তাদের দাবি হচ্ছে, যতদিন পর্যন্ত এই সংকটের সুরাহা না হচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো যাতে রোহিঙ্গাদের মতো তাদেরও খ্যাদ্য এবং অন্যান্য সহায়তা দেয়।
পাশাপাশি সে এলাকায় কর্মরত বেসরকারি সংস্থাগুলোতে চাকরির ক্ষেত্রে স্থানীয়দের প্রাধান্য দেয়া হয় সে দাবিও রয়েছে তাদের।
সৌজন্যে : বিবিসি বাংলা
পাঠকের মতামত